এবারের শারদ উৎসব এর
বিশেষ প্রবন্ধ
*গৌতম বসুমল্লিক*
*বাংলার দুর্গাআপ্রতিমা ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের চতুর্বর্ণকে উপস্থাপিত করে*
==========================
বর্তমানে বঙ্গদেশ-সহ সর্বত্র সরস্বতী-কার্তিক-লক্ষ্মী-গণেশযুক্ত দেবী দুর্গার যে সপরিবার মূর্তি দেখা যায় এবং তাতে পুজো হয় তা প্রাচীন ভারতের হিন্দু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র— এই চার বর্ণকে উপস্থাপিত করে।
ভারতীয় পুরাণ-সংস্কৃতিতে সরস্বতী বহুমাত্রিক দেবী হিসাবে পরিচিত। আদিতে সরস্বতীর পরিচয় ছিল উত্তর ভারতের সপ্তনদীর (গঙ্গা, যমুনা, শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা ও সরস্বতী) অন্যতমা সরস্বতী নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে। পরবর্তীকালে সেই নদীর দেবতা শিক্ষা ও সংস্কৃতির অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে পরিচিতি লাভ করে, যা ব্রাহ্মণ্যত্বের প্রতীক।কার্তিক সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হল তিনি শিব-পার্বতীর দ্বিতীয় পুত্র, রণনিপূণ, ময়ূরবাহন, স্বর্গরাজ্য বা দেবতাদের সেনাবাহিনীর প্রধান। সেই সূত্রে কার্তিক ক্ষত্রিয়ত্বর প্রতীক।
বৈদিক শাস্ত্র ও বিভিন্ন পুরাণ অনুসারে লক্ষ্মীর উদ্ভব ও পরিচিতি নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিছু পুরাণ অনুযায়ী লক্ষ্মী দেবসেনা রূপে জন্ম নিয়ে কার্তিকেয়র পত্নী হন। আবার কিছু পুরাণ মতে তিনি গণেশপত্নী। আবার শস্যের দেবী হিসাবে গণ্য হবার কারণে লক্ষ্মীকে ধরিত্রী বা বসুমতী হিসাবেও ভাবা আরম্ভ হয় বলে তিনি বৈশ্যত্বের প্রতীক।
পার্বতী-সুত ‘লম্বোদর’ বা ‘গণেশ’ মূলত ভারতের পশ্চিম অংশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান আরাধ্য দেবতা হলেও ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানেও এর পুজোর প্রচলন আছে। ইতিহাবিদ ও ধর্মতত্ত্ব বিশারদদের মতে এই গণেশ বা গণপতি মূলত লৌকিক দেবতা, যার উদ্ভব প্রাগার্য যুগে। লৌকিক দেবতা গণপতি তাই আমজনতা শুদ্রত্বের প্রতীক।
কেন তা এই রকম তা জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে দুর্গা মূর্তির উৎস সন্ধানে। দুর্গাপুজো বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব হলেও ইতিহাস থেকে দেখা যায়, সমগ্র ভারত জুড়েই এই পুজোর প্রচলন আছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে দেবী দুর্গা বিভিন্ন নামে পূজিতা হন। জম্মুতে ‘বৈষ্ণোদেবী’, কাশ্মীরে ‘অম্বা’ হিমাচলে ‘ভীমা’, হরিদ্বারে ‘হরিপ্রিয়া’, গুজরাটে ‘হিঙ্গলা’ ও ‘রুদ্রানী’, রাজস্থানে ‘ভবানী’, অমরকন্টকে ‘চণ্ডিকা’, মিথিলায় ‘উমা’, কর্নাটকে ‘কল্যাণী’ ও ‘জয়দুর্গা’, বিন্ধ্যচলে ‘বিন্ধ্যবাসিনী’, দাক্ষিণাত্যে ‘অম্বিকা’, কন্যাকুমারিকায় ‘কন্যাকুমারী’ এবং বঙ্গদেশের ‘দুর্গা’ প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত। এই সমস্ত দেবী শক্তির এক একটা রূপ বলে পরিচিত এবং প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বিগ্রহ বা মূর্তি আছে।
বঙ্গদেশে যে মূর্তিতে দুর্গাপুজো হয় তা সাধারণ ভাবে মহিষাসুরমর্দিনী রূপ হিসেবে পরিচিত হলেও আদতে এটা একটা মিশ্র রূপ। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে অনুমান করা হয় যে বঙ্গদেশে প্রাক-খ্রিস্টীয় যুগ থেকেই মূর্তিপুজোর প্রচলন আরম্ভ হয়েছিল। সেই সময়কার কৌম-সমাজে পূজিতা বিভিন্ন দেবী মূর্তিতে যে আদিম মাতৃকা রূপ ছিল, সেগুলিই পরবর্তীকালে পরিশীলিত রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই বিবর্তন মূলত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতকের মধ্যে ঘটেছে। প্রাক-ব্রাহ্মণ্য যুগের যক্ষী, নাগী, অপ্সরা, দোহদ পরিচয়ের নারী মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এদের মধ্যে যক্ষীদের কেশের খোঁপার দু’পাশে বাণ, পরশু, অঙ্কুশ, বজ্র ও ত্রিশূল— এই পাঁচটি ছোট আকারের অস্ত্র দেখা যায়। দেখা গিয়েছে, ওই পাঁচটি অস্ত্রই পরবর্তীকালে দ্বিভুজা, চর্তুভুজা, অষ্টভুজা, দশভুজা বা অষ্টাদশভুজা দেবী মূর্তির হাতে উঠে এসেছে। কোনও ক্ষেত্রে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু অস্ত্র।
প্রাপ্ত দুর্গার মূর্তিগুলির দু’টি রূপ পাওয়া যায়— মহিষমর্দিনী এবং সিংহবাহিনী। এর মধ্যে সম্ভবত মহিষমর্দিনী রূপটিই প্রাচীন। রাজস্থানের নাগোর থেকে পাওয়া আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের একটি ক্ষুদ্রাকৃতি ফলককে মহিষমর্দিনী রূপের প্রাচীনতম নিদর্শন বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন। সিংহবাহিনী রূপটি সম্ভবত এসেছে ভারতের বাইরে থেকে। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকেই খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে নির্মিত মহিষমর্দিনী ও সিংহবাহিনীরূপী দেবীমূর্তির নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। ওই সময়কার কিছু পাথরের তৈরি চর্তুভুজা, ষড়ভুজা, অষ্টভুজা মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি আবার সিংহবিহীন। উত্তরপ্রদেশের নিকটবর্তী ভিটা ও বিহারের বৈশালী অঞ্চলে পাওয়া সিলমোহরের মহিষমর্দিনী মূর্তিতে সিংহ নেই। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, সিংহ-সহ মহিষমর্দিনী মূর্তি এসেছে সপ্তম শতাব্দী থেকে। অর্থাৎ, বুদ্ধযুগ থেকে হিন্দুযুগে প্রত্যাবর্তনের গোড়ার দিক থেকে মহিষমর্দিনী মূর্তি আস্তে আস্তে সিংহবাহিনী হয়ে উঠেছে। এবং ওই সসিংহ মহিষমর্দিনী রূপ অনুসরণেই পরবর্তীকালে বাংলার দুর্গামূর্ত গড়ে উঠেছে।বাংলায় কবে থেকে মৃন্ময়ী অর্থাৎ, মাটির মূর্তি তৈরি আরম্ভ হয়েছে তা ঠিক নির্ণীত নয়। পাথরের মূর্তির স্থায়িত্ব অনেক বেশি বলে বহু যুগ পূর্বের মূর্তিও মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় কিন্তু মাটির তৈরি মূর্তি রোদে, জলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে খুব প্রাচীন মৃন্ময়ী প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তি পাওয়া যায় কম। অধুনা বাংলাদেশের বগুড়ার সর্ষবাজ গ্রাম থেকে পাওয়া আনুমানিক তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীর অষ্টভুজা সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনী রূপের পোড়ামাটির মূর্তিই এখনও পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীনতম মৃন্ময়ী দুর্গামূর্তি। এ ছাড়া পাহাড়পুরে পাওয়া নবম-দশম শতাব্দীর একটা পোড়ামাটির দশভুজা মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। জনশ্রুতি অনুসারে বলা হয়ে থাকে নদিয়ারাজ ভবানন্দ মজুমদার মানসিংহের সুপারিশে মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে জমিদারি পেয়ে বাগোয়ান গ্রামের ভদ্রাসনে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মৃন্ময়ী মূর্তিতে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। কেউ কেউ আবার বলেন, তাহিরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ (বা মতান্তরে উদনারায়ণ) বাংলায় দুর্গাপুজো আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু বাংলার শাস্ত্রকারেদের অনেকের বর্ণনাতেই মৃন্ময়ী মূর্তিতে পুজো করার উল্লেখ রয়েছে। বাংলার বর্তমান পুজো পদ্ধতি ও সামাজিক রীতিনীতির প্রবর্তক চৈতন্য সমসায়িক স্মার্ত রঘুনন্দনের ‘দুগোর্ৎসবতত্ত্ব’ ও ‘দুর্গাপুজো পদ্ধতি’তে মাটি দিয়ে প্রতিমা গড়ার আলোচনা আছে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, মাটি খুঁড়ে প্রাপ্ত প্রায় সমস্ত প্রস্তরমূর্তিই দেবী দুর্গার একক মূর্তি। একটা-দুটো ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও চালের সঙ্গে যক্ষীর অবয়ব পাওয়া গেলেও এখনকার মতো লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশযুক্ত দেবী দুর্গার মূর্তি প্রাচীন কালে ছিল না। এই সংযোজন হয়েছে মৃন্ময়ী মূর্তি আসারও অনেক পরে। কিন্তু ঠিক কোন সময়ে এগুলো এসেছে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মঙ্গলকাব্যের বিবরণ ছাড়া সপরিবার দুর্গার আর কোনও লিখিত বা পাথুরে প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি যা থেকে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশকে দুর্গার পুত্রকন্যা হিসেবে একই চালের মধ্যে কবে থেকে আনা হয়েছে তা বলা যায়। মাটির তৈরি অস্থায়ী মূর্তির যেহেতু কোনও প্রমাণ পরবর্তীকালে থাকে না তাই প্রমাণ বলতে এখন পাওয়া যায় মন্দির টেরাকোটায়। তবে সেগুলো প্রায় সবই অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেকার নয়। হাওড়া-আমতার রাউতাড়া গ্রামে অষ্টাদশ শতাব্দীরে তৈরি মন্দিরে পাওয়া যায় সপরিবার দুর্গামূতি, হুগলি জেলার বালি দেওয়ানগঞ্জের জোড়বাংলার ওপর নবরত্ন মন্দিরেও রয়েছে এমন দুর্গামূর্তি।
বর্তমান রায়বেশে সম্প্রদায়ের জীবন ও সংস্কৃতি
ধীমান ব্রহ্মচারী
ভারতবর্ষের ইতিহাস খুবই বিস্তৃত এবং সমৃদ্ধ।নানা ভাষা-বর্ণ-জাতির মানুষ এই ভারত্মার বুকে বহুকাল ধরে বর্তমান সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এতবড় মহাখণ্ডের বাংলা ভাষা র অন্যতম অঞ্চল তথা আমাদের পশ্চিমবাংলা। যে বাংলায় রয়েছে বিভিন্ন উপভাষা ও বর্ন বৈচিত্র্য ময় মানুষ।সর্বত্রই রয়েছে এই আঞ্চলিক ভাষা নির্ভর মানবজাতি ও জনগোষ্ঠি।এমনই বহুকাল ধরেই বিভিন্ন আঞ্চলিক জাতিগুলি র জীবন যাত্ৰা ও শিল্প-সংস্কৃতি বজায় রেখেছে কালের নিয়মানুযায়ী।আমাদের দেশের ঐতিহাসিক একটি সন্ধিক্ষন তাহল সামন্ত যুগ।যে সময়ে নায়েব-গোমস্তা-জমিদার বাবুদের দেহরক্ষী থাকত সনডা গোছের বেশকিছু পালোয়ান।তাদের গা থাকত খালি।ফতুয়া, গেঞ্জি থাকত তা কাঁধেই ফেলা থাকত।শরীর চর্চায় এই সমস্ত লাঠিয়াল বা পালোয়ান রা ছিল পটু।
বর্তমানে সমন্ত যুগ শেষ।লেঠেল নিয়ে বিয়ে করতে যাওয়ার রিটিও গেছে ঘুচে।বাগদি, ভল্লা,বাউরি লোহার,হাড়ি সম্পদায় ভুক্ত লেঠেলদের পরিবারটি বর্তমানে এখন শ্রমিক, কেউবা কৃষক।সভ্যতা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি কেউ ছোট বড় কুঠির শিল্প যেমন ঝুড়ি মোড়া বনায় মনোনিবেশ করেছে।
তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে জমিদারি প্রথার অবলুপ্তির পর বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, কাটোয়া এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমিদাররাও লেঠেল রাখত।আর সেই সময় এই লেঠেলরা আবার নাচ-গান,শরীরী কসরত মিলিয়ে একরকম নতুন 'রণনৃত্য'-এর সূচনা করেছিল।এই আঙ্গিক কেই গ্রাম্য কথায় 'রায়বেশে' বলা হয়েছে। আমরাও যেমন পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্যের কথা জেনেছি।আবার রায়বেশে দের মতোও হাওড়া র সং(সঙ)দের নৃত্যের কথা জেনেছি
... রায়বেশে র গান--
"করব না আর বিয়ে
করব না আর বিয়ে
বিয়ের আশা মিটে গেছে
দাদার বিয়ে দিয়ে"
তেমনই আবার হাওড়া র 'সং'-এর গান-
"খুরুটে দোলের সঙ
ফাঁকা নয় আছে ঢং
একটি আনা খরচ করে
বাবুরা সব দেখুন পড়ে"।
তবে জমিদারি চলে যাবার পর বীর নৃত্য হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে জমীদারদেরই চেষ্টাতে। পৌরষ প্রদর্শন করাই এই নৃত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য।অর্থাৎ নামকরণ টা দেখলেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে তার ঐশ্বর্য্য টি আসলে কি?
'রায়' অর্থাৎ 'বড়' বা 'সম্ভ্রান্ত'।অন্য দিকে 'বেশে' অর্থাৎ বাঁশ ব্যবহারকারী বা বাঁশ থেকে তৈরি।এইভাবেই শক্তপোক্ত লাঠি নিয়ে নানান ব্যায়াম ভিত্তিক কসরত এমনকি ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক নাচ ই 'রায়বেশে'।এরই মধ্যে আছে ব্যালেন্সের খেলা, চোখের নিমেষে আগুনের গোলার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া।আবার মানুষের কাঁধে মানুষ চেপে পিরামিডের মতো প্রায় ফুট পনেরো'র বেশি 'মানবস্তম্ভ' বানানো, রণপা পড়ে হেঁটে চলা, সখী নাচ দেখান, আবার বাঁশ নিয়ে উল্টে পাল্টে শরীর নিয়ে খেলা করা।এমনও শোনা যায়,কোন কোন রায়বেশে ওস্তাদ এমন লাঠি ঘোরাতে পারতেন যে, ঢিল ছুঁড়েও তাকে আহত করা যেত না।
কিন্তু বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতায় এই রায়বেশে দের জীবন হয়ে উঠেছে দিশেহারা।বর্তমানে কেইবা এদের খেলা বা রণনৃত্য দেখবে? জীবন বাঁচাতেও রায়বেশের শিল্পীরাও দিশেহারা।জীবন ধারণের জন্যে নানান পেশায় ঝুঁকেছে।মূল রাজা বা জমিদারদের আমলেই রায়বেশের প্রাধান্য ছিল অনেক টা বেশি।রাজরাজরাদের কাজের জন্য রায়বেশে রা জমিদার থেকে মাসিক ভাতা পেত।এমনকি জমিদাররা রায়বেশেদের বসবাসের জন্য একটা গ্রাম ই দান করেছিলেন।--একটু তথ্য নিয়ে দেখি।গ্রামের নাম চারকোল।এই গ্রামেরই শিবরাম প্রামানিক রায়বেশে দের জীবিত শ্রেষ্ঠ গুরু বা ওস্তাদ।
মুর্শিদাবাদের আলু গ্রামের স্বপন হাজরা, কাতুরের স্বাধীন বিত্তার,বীরভূমের সৌজগ্রামের ভাগ্যধর ভুঁইমালী,ভালকুঠির বলহরি বাগদি প্রমুখেরা শিবরাম প্রানানিকের মতোই বিখ্যাত।কিন্তু নানা কারণে ই এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিল্প-সংস্কৃতি র ধারাবাহিকতা বজায় থাকছেনা।তবে ফিংতোড়,সোঁজ,খুস্টিকুড়ি,মারুলি ডাঙ্গাল,উলকুন্ডা-ন'পাড়া এলাকায় আবার নতুন ভাবে কয়েকজন যুবক এগিয়ে এসেছেন।যেমন মারুলি ডাঙ্গালের কাজল ভুঁইমালী,রামচন্দ্র ভুঁইমালী,জয়দেব হাজরা, নকুল বিত্তার, বাবুরাম মুর্মু, শ্যামলাল প্রমুখেরা নতুন দল করেছে।এমনকি হালে রামনগর, সাহোড়া-চন্দ্রহাট মিলিয়ে বাসুদেব ভল্লা, চিত্তরঞ্জন গোড়াইরা ২৫-৩০জনের একটি রায়বেশে দল গড়েছে।
রায়বেশে নাচ দেখেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,'এরকম পুরুষোচিত নাচ দূর্লভ।আমাদের চিত্ত-দৌর্বল্য দূর করতে পারে এই নাচ।' আবার রবীন্দ্রনাথের আগ্রহেই শান্তিদেব ঘোষ রবীন্দ্র নাট্য 'নবীন' নাটকে রায়বেশে আঙ্গিকের কিছু নাচের সংযোগ ঘটিয়েছিলেন।অথচ কালের প্রবাহের নিরিখে লোকায়ত সংস্কৃতি ভিন্ন আর কিছু ই ভাবা যাচ্ছেনা, সবই কেমন যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।
আসলে পার্থিব জগতে এবং প্রকৃতির রাজ্যে সবসময় কাজকরে চলেছে দুটো শক্তি।একটি শুভ ও দ্বিতীয়টি অশুভ।শুভ শক্তির বন্দনা এবং অশুভ শক্তির বিনাশ ও বিতাড়নের উদ্দেশ্যেই আদিম যুগের মানুষ নানান আচার-অনুষ্ঠান পালন করত।আর এই আচারের নিদর্শন পাই আমরা প্রাচীন গুহা চিত্রে।শিকারে বা যুদ্ধে যাবার আগে তারা দল বেঁধে নাচত।জাদুনৃত্য, রোণনৃত্যও।আদিম 'জাদুনৃত্য' থেকেই একদা রোণনৃত্যের সূচনা হয়েছে।প্রাচীন টেরাকোটা, পাথরের মুখোশ, আংশিক ভাবে সমর্থন করাই যায়।যুদ্ধনৃত্যও ছিল যুদ্ধ আঙ্গিকের একরকম নৃত্য।
রায়বেশের উল্লেখ পাওয়া যায় তারাশঙ্করের পঞ্চগ্রাম, হাঁসুলিবাঁকের উপকথা,কালান্তর, আরোগ্য নিকেতন প্রভৃতি উপন্যাসে।তারাশঙ্করের জীবনে এই রায়বেশে নিয়ে একটা বড় ঘটনা হয়েছে।
১৯৩০সালে জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে বোলপুরের কাছারি পট্টি তে একটি প্রেস করেছিলেন।যার যন্ত্রাংশ কিনে এনেছিলেন 'শনিবারের চিঠি'র সপাদক সজনীকান্তদাস এবং তখন বীরভূমের জেলাশাসক ছিলেন গুরু সদয় দত্ত।তিনি রায়বেশে থেকে ব্রতচারীর সৃষ্টি করেছেন এবং বাধ্যতা মূলক ভাবে গ্রামের স্কুলে স্কুলে তাই চালাচ্ছেন।ব্রতচারীর প্রচার ও প্রসারে তিনি উঠে পড়ে লেগেছেন।বিষয় টি দেশ সেবক স্বদেশি কংগ্রেস আন্দোলনকারী দের ভালো লাগেনি।সেই সময় রায়পুরের ক্রুদ্ধ ব্যোমকেশ চট্টপাধ্যায় সেই রায়বেশের বা ব্রতচারীর প্রতিবাদেই একটি ব্যঙ্গ কবিত লিখে তারাশঙ্করের প্রেসের কর্মীদের সহায় চেপে ছিলেন গোপনে।ঘটনার ঘনঘটাতে প্রেসের নামটুকু দেখেই গুরু সদয় দত্ত তারাশঙ্করের বিরুদ্ধে দু হাজার টাকা আর ব্যোমকেশের বিরুদ্ধে ১৪৪ধারা জারি করেন।সেই সময় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোলপুর পৌঁছান,বিষয় নিয়ে তারাশঙ্করের সাথে কথা বলেছিলেন।সেই মতো দু হাজার টাকায় মামলা তুলে দেওয়া হল।শেষ করার মুহূর্তে ব্যাঙ্গ কবিতাটি তুলে দি...
"দিদির বিয়ে যেমন তেমন
দাদার বিয়ে রায়বেশে
আয় ঢোকা মদ খেসে
ভদ্র লোকের ছেলেগুলো
নাচছে এবার রায়বেশে,
দেখেশুনে আর বাঁচিনে
নেশার গুমোর যায় বা ফেঁসে।
গান্ধী রাজার হুকুম মতো...
তথ্য সুত্র:
1) হাওড়ার সং- এখন তখন/ দেবাশীষ ঘোষ
2) রায়বেশের জীবন ও শিল্প/আদিত্য মুখোপাধ্যায়